বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিশেষ প্রতিবেদন

কৌশলে মহিষের অস্বাস্থ্যকর সেদ্ধ মাংস ঢুকছে দেশে

নিজস্ব প্রতিবেদক
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে হিমায়িত মহিষের মাংস। দাম ২৫০-৩০০ টাকা। ফেসবুকে এ রকম মাংস বিক্রির চটকদার বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে। তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভেসে আসলো বেশ কয়েকটি ফেসবুক ফেজ। এ রকমই একটি পেজ 'আমজাদ বাজার অনলাইন শপ'। হিমায়িত মাংসের একটি ভিডিও দিয়ে তারা লিখিছে, 'সিদ্ধ করা ফ্রোজেন মহিষের মাংস ঢাকা সিটিতে হোম ডেলিভারি এবং সারা বাংলাদেশে কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হয়।' যোগাযোগের জন্য দেওয়া মোবাইল নম্বরে পরিচয় গোপন করে একটি হোটেলের মালিক সেজে কল করা হলে অপর প্রান্ত থেকে একজন বলেন, 'ইন্ডিয়া থেকে মহিষের মাংস আগে কাঁচা আসতো। এখন আর সেভাবে আনতে দিচ্ছে না। ফলে ভারতে মাংসে লবন ও হলুদ মিশিয়ে সিদ্ধ করা হচ্ছে। হাড় ছাড়া মাংস ছোট টুকরো করে কাটা হয়। গরম করার কারণে মাংসের ভেতরে রস পুরোপুরি বের হয়ে যায়। শুকিয়ে প্যাকেট করে এ দেশে পাঠানো হয়।  তিন কেজি মাংস নতুন করে হোটেলে রান্না করলে ছয় কেজির সমান হয়ে যায়। এটা অকল্পনীয়। এগুলো দেশে এনে আমরা কোল্ড স্টোরে রেখে হোটেলে বিক্রি করি। আমাদের স্টকে এখন পাঁচ টন মাংস আছে। জায়গা মতো মাংস পৌঁছে দেই। যে হোটেল একবার এ মাংস নেয়, সে আর বাজারের কাঁচা মাংস নেয় না। এ মাংসে অনেক লাভ। ঢাকার হোটেলে ব্যাপক চাহিদা।'

গরুর মাংসে উদ্বৃত্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও দেশে হিমায়িত মহিষের মাংস বৈধ-অবৈধ পথে আসছিল টনে টনে। স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও প্রান্তিক খামারিদের কথা চিন্তা করে সরকার গত বছর থেকে হিমায়িত মাংস আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া মহিষের মাংস আমদানি হচ্ছে না। আর অধিদপ্তর গত দেড় বছর কাউকে অনুমতি দেয়নি। একটি চক্র নানা দৌড়ঝাপের পর ব্যর্থ হয়ে নতুন কৌশল নিয়েছে। কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের নামে সিদ্ধ মাংস প্যাকেট করে দেশের হোটেলে সরবরাহ করছে। 

রাজধানীর নিউ মার্কেটের একটি হোটেলের মালিক জাফরুল্লাহর সঙ্গে কথা হয় সমকালের। তিনি বলেন, 'প্যাকেট করা সিদ্ধ শুকনা মাংস নিয়মিত অনলাইন থেকে কেনা হয়। রান্না করার পর এটা ফুলে উঠে। লাভও বেশি। 

কারওয়ান বাজারের এক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, 'এক সময় কাঁচা হিমায়িত মাংস কিনে রান্না করতাম। এখন সেই মাংস পাওয়া যায় না। গত কয়েক মাস ধরে সিদ্ধ মাংস কিনছি। কেজি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কেটে ছোট করে রান্না করার পর তিন কেজির মতো হয়ে যায়।'  কারওয়ান বাজারের এক মাংস ব্যবসায়ী বলেন, 'এ মাংস মূলত অনলাইনেই বিক্রি হয়। আমদানিকারকরা সিদ্ধ মাংস এনে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কোল্ডস্টোরেজে রেখে দেন। সেখান থেকে অনেকে কিনে নিয়ে হোটেলে সরবরাহ করে।' 

অনলাইন শপের ফেসবুক পেইজে আপ করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একটি রুমে থরে থরে সাজানো মাংসের প্যাকেট। সাধারণ পলিথিনে রাখা মাংসে মেয়াদে দেওয়া হয়েছে ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত। 

দেশে মাংসের উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দামও। গরুর মাংস সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। আর এ জন্য সংশ্লিষ্টরা দায়ী করেছেন সিন্ডিকেটকে। খামারি ও মাংস ব্যবসায়ীরা মাংসের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি জানালেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এমন পরিস্থতিতে মূল্যবৃদ্ধিকে পুঁজি করে দেশে ফের হিমায়িত মহিষের মাংস আমদানির পাঁয়তারা চলছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরুর মাংস আমদানি হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রান্তিক খামারিরা। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস নামার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়বে। এ জন্য যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন তারা।  

যে কারণে মহিষের মাংস আমদানিতে কড়াকড়ি

ভারতের নরেন্দ্র মোদীর সরকার আকস্মিকভাবেই ২০১৫ সালে তাদের দেশ থেকে বাংলাদেশে গরু প্রবেশের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। সেই থেকে দেশের কৃষক এবং খামারিদের গরু দিয়ে ঈদে কোরবানির চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে। গেল কোরবানির ঈদেই ২৪ লাখ ৯৪ হাজার ৫২১টি পশু অবিক্রিত থেকে গেছে। এতে এখনও লোকসানের বোঝা টানছেন খামারিরা। 

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফ) এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১২ লাখ খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ৯৪ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। 

ডিএলএস এর ২০২৩ এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০১-০২ সালে মাংস উৎপাদন ছিল প্রায় ৯ লাখ টন এবং ২০২১-২২ সালে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৯৩ লাখ টন। গত ১০ বছরে মাংস উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৫৬ শতাংশ। ৭.৪ মিলিয়ন টন মাংসের চাহিদার বিপরীতে ৮.৪৪ মিলিয়ন টন মাংস উৎপাদন হচ্ছে। ফলে গত বছর থেকে মাংস আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কেবল তা-ই নয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে মাংস রপ্তানির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। 

তুবও ভিন্ন কৌশল

আমদানি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কঠোর অবস্থানের মধ্যেও ২০২২-২৩ সালে ৯৭৪ টন হাঁড়ছাড়া হিমায়িত বোভাইন মিট আমদানি হয় বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এসব পণ্যের আমদানি মূল্য ৪৪ কোটি টাকা। 

গত ১০ মে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়েই ভারত থেকে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে এক টন হিমায়িত মহিষের মাংস দেশে আনে মেডলাইফ প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি কোম্পানি। মাংস দিয়ে আঁচার বানিয়ে রপ্তানি করার ঘোষণা থাকলেও তাদের নেই কোনো কারখানা। পরে মাংসগুলো রাজধানীর একটি কোল্ড স্টোরেজে জব্দ করে রাখা হয়। দীর্ঘ ৮০ দিন পর গত ২ আগস্ট উচ্চ আদালতের নির্দেশে মাংসগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচা মাংস আমদানি করতে না পেরে এখন প্রক্রিয়াজাত মাংসের প্যাকেট এনে হোটেলে বিক্রি করা হচ্ছে। ঢাকার অন্তত ১০টি হোটেলে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, ৬টি হোটেলেই ভারত থেকে আসা সিদ্ধ মাংস নিয়মিত রান্না হচ্ছে। 

একটি সূত্র জানিয়েছে, সিদ্ধ মাংস আমদানি করা ছাড়াও চক্রটি আমদানির অনুমতি নিতে নিয়মিত দৌড়ঝাপ করছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সহায়তা ও পরামর্শ নিয়ে মাংস আমদানির অনুমতির জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে তদবির চলছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আমদানিকারকরা বাজার অস্থতিশীল করতেও তৎপর। মাংসের দাম বৃদ্ধিকে পুঁজি করে তারা মাংস আমদানি করতে চাচ্ছে। এ লক্ষ্যে তারা মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও রেঁস্তোরা মালিক সমিতিকে দিয়ে মাংস আমদানির পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করিয়েছে। 

এমনকি বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ গত ২৫ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে বিদেশ থেকে গরুর মাংস আমদানির পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। তবে দেশীয় উৎপাদকদের সুরক্ষা দিতে গরুর মাংস আমদানি করা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

এক মাংস আমদানিকারকের একটি টেলিফোন আলাপের অডিও এসেছে। সেখানে তিনি একজনকে বলছেন, 'রান্না করা (সিদ্ধ) মাংস আমদানি আইনসম্মত। যতদিন মাংস আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে না ততদিন সিদ্ধ মাংস বিক্রি করতে হবে। মাংস আমদানির অনুমতির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক সহায়তা দিচ্ছেন। তিনি চট্টগ্রামে কর্মরত থাকা অবস্থায় আমদানিকারকদের একটি সনদ দিয়ে মাংস প্রবেশে বড় ভূমিকা রেখেছেন। এবার তিনি ডিজি হলে সব উন্মুক্ত করে দেবেন।'

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেয়াজুল হক চট্টগ্রাম জেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ফাইটোস্যানিটেশন সার্টিফিকেটের মাধ্যমে মাংস এনে লাখ লাখ টাকা আমদানিকারকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন। এখনও সেই আমদানিকারকদের সঙ্গে তার সখ্যতা আছে।  

ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক সমকালকে বলেন, কাঁচা মাংস আনতে আমাদের অনুমতি লাগে। কোনো পণ্য সিদ্ধ করার পর তা খাদ্য হয়ে যায়। তখন আর আমাদের কিছু বলার থাকে না। মাংস আমদানির বিষয়ে তিনি বলেন, দাম বেশি থাকলে আমদানি, আবার দাম কমলে আমদানি বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। যখন দাম বেশি থাকে তখন উদ্বৃত থাকার পরও চাল, পেঁয়াজ, রসুনের মতো পণ্য আমদানি হচ্ছে। এতে ভোক্তা উপকৃত হচ্ছেন। 

বাংলাদেশ মিট ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমআইটিএ) সভাপতি শামীম আহম্মেদ বলেন, ‘গত বছরের এপ্রিল থেকে মাংস আমদানি একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের ব্যবসা বন্ধ। এক সময় কেজি ১৫০ টাকা করে আমরা মাংস দিতে পারতাম। ফ্রোজেন মিট এর প্রধান গ্রাহক প্রান্তিক শ্রেণির ক্রেতারা। এছাড়া বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্ট ফ্রোজেন মিটগুলোর ক্রেতা। গার্মেন্সে এক সময় সপ্তাহে দুদিন আমদানি মাংস খাওয়ানো হতো। অথচ এখন আমদানি বন্ধ থাকার ফলে দাম যেমন বাড়ছে, আবার দেশের পুষ্টি নিরাপত্তাও হুমকিতে পড়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কোনো এক ব্যক্তিগত কারণে আমদানির অনুমতি দিচ্ছেন না।'

গ্লোবাল প্রোডাক্ট প্রাইজ নামের একটি ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, দাম বৃদ্ধির দিক থেকে ৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম। দেশের বাজারে গরুর মাংসের সংকট নেই। তবে গত এক বছরে পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। এ ছাড়া সার্বিক উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও বেশি মাংস উৎপাদনকারী উন্নত প্রজাতির গরু না থাকায় বাজারে গরুর মাংসের দাম কমছে না। তারপরও আমাদের খামারিরা গত জুলাই থেকে বাজারের চেয়ে ৫০ টাকা কমে মাংস বিক্রি করছেন। মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া দাবি জানিয়েছি। আশাকরি দাম কমে আসবে। 

বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বলেন, সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না করার কারণে অনেক ক্ষেত্রে গরুর মাংসের পুষ্টিগুণ নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্নিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে। প্রক্রিয়াজাত মাংসে বেশি পরিমাণ লবণ এবং কিছু রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয়। ফলে এসব খাবারে নানা রোগ-ব্যাধিসহ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। 

পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, গবাদিপশু উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্যবিমোচন ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। বিদেশ থেকে মাংস আমদানি করলে পুরো খাত বিপদে পড়বে। সরকারের উচিত এ খাতের ক্ষতি হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধির জন্য বাজার ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে বলেন, সারা বছর চাহিদা মেটানোর পরও গরু উদ্বৃত্ত থাকছে। সেজন্য এখন বিদেশে মাংস রপ্তানির পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার এবং দেশের খামারগুলোকে সম্প্রসারণে নানা সুবিধা দিচ্ছে। মাংস আমদানি করার মতো পরিস্থতি এখন আর দেশে নেই। 

বাজারে এসেছে স্যামসাংয়ের নতুন টেলিভিশন সিরিজ
সঙ্গেীতের সুরেলা পাখি হয়ে থাকতে চান মনিষা

আপনার মতামত লিখুন